রবিবার, ১৯শে মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

সংরক্ষণের অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে ২শত বছরের পুরনো নীলকুঠি


নীলফামারী প্রতিনিধি


কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে নীলফামারী জেলা সদরের পলাশবাড়ী ইউনিয়নের নটখানা গ্রামের নীলকুঠি। নীল চাষের জন্য ব্রিটিশ শাসনামলে কৃষকদের ওপর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাহেবদের নির্মম নির্যাতনের চিহ্ন বহন করছে ভবনটি। কিন্তু সংস্কারের অভাবে জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে দুইশত বছরের পুরনো এই নীলকুঠি। অবকাঠামো টিকে থাকলেও সংরক্ষণের উদ্যোগ নেই।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ইংরেজরা ২২২ বছর আগে উত্তরের জেলা নীলফামারীতে নীল চাষের জন্য ‘নীলকুঠি’ নামে একটি খামার স্থাপন করেছিল। এই অঞ্চলের মাটি উর্বর হওয়ায় সেসময় এখানে বেশি নীল চাষ হতো। এ কারণে নীলকরদের আস্তানা গড়ে ওঠে জেলা সদরের পলাশবাড়ী ইউনিয়নের নটখানা গ্রামে। নীলকুঠি ছাড়াও নীলফামারীতে পুরাকীর্তি হিসেবে রয়েছে ভিমের মায়ের চুলা, ১০০ বছরের পুরনো হাতির পানি খাওয়া কড়াই, নীলসাগর, কুন্দুপুকুর মাজার, হাজার বছরের পুরনো গির্জা, রাজা হরিশচন্দ্রের প্রাসাদ, হরেন্দ্র গোস্বামী কাছারি বাড়ি ও ধর্মপালের গড়। তবে এসব দর্শনীয় স্থানও সংরক্ষণের নেই কোনও উদ্যোগ।


ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৮০০ সালে নটখানা গ্রামে নীল চাষের একটি বৃহৎ খামার স্থাপন করে ইংরেজরা। ১৮৪৭-৪৮ সালে ক্ষতিগ্রস্ত হলে নীল চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় কৃষক। তখন ইংরেজদের জুলুম ও নির্যাতনের শিকার হন কৃষকরা। ১৮৫৯-৬০ সালের দিকে স্থানীয় কৃষকদের আন্দোলনের ফলে নীল চাষ বন্ধ হয়ে যায়। তখন কৃষক আন্দোলনের মুখে পালিয়ে যায় নীলকররা। সেই নীলখামার থেকে নীলফামারী নামের উৎপত্তি হয়। তবে সেখানে এখনও দাঁড়িয়ে আছে সেই পুরনো ভবনটি। যা ব্রিটিশ আমলের অত্যাচারের স্মৃতি বহন করে এখনও। পরবর্তী প্রজন্ম জানতে পারে ১৮০০ সালে জেলা শহরের অদূরে নটখানায় নীল চাষ হতো। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ব্রিটিশের তৈরি নীলকুঠিটি সংরক্ষণের দাবি জানান স্থানীয়রা।


সরেজমিনে দেখা গেছে, নীলকুঠি ভবনের পূর্ব দিকের অংশের প্রায় তিন শতাধিক ইট খুলে নিয়ে গেছে অজ্ঞাতরা। স্থানীয়রা বলছেন, নীলকুঠির সঙ্গে নীলফামারীর ঐতিহ্য, ইতিহাস ও নামকরণ জড়িত আছে। বর্তমানে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় পুরাকীর্তি হিসেবে সংরক্ষণের কাজটি হাতে নেয়। এটি এখনও সংরক্ষণের কাজ শুরু হয়নি।
ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. ইব্রাহিম তালুকদার বাংলা সময়কে বলেন, ‘সেসময় নীল চাষে বাধ্য করা হতো এই অঞ্চলের কৃষকদের। নীলকররা ওই স্থাপনাটি নির্মাণ করে সেখানে কার্যক্রম চালাতো।


তিনি আরও বলেন, শুনেছি ভবনের ভেতরে কৃষকদের নির্যাতন করা হতো। ভেতরে টর্চার সেল আছে। আর মহকুমা অফিস ছিল জেলা শহরের কালেক্টরেট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ চত্বরে। এখন এটি অফিসার্স ক্লাব হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এছাড়া উৎপাদিত পণ্য জেলা শহরের শাখা ও মাচা নামের দুটি বন্দর দিয়ে নদীপথে আনা-নেওয়ার কাজ করতো। ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ভবনটি সংরক্ষণের দাবি জানাই আমরা।


ওই গ্রামের বাসিন্দা মো. আফসার উদ্দিন (৬০), আকমল হোসেন (৬০) জানান, ভবনটি স্মৃতি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অযত্ন আর অবহেলায় একসময় এটি হারিয়ে যাবে। শুনেছি, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় পুরাকীর্তি হিসেবে সংরক্ষণের কাজটি হাতে নিয়েছে। ১০ বছর পার হয়েছে। কিন্তু আজও বাস্তবায়ন হয়নি।


নীলফামারী চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ড্রাস্ট্রির সভাপতি প্রকৌশলী এসএম শফিকুল আলম ডাবলু বাংলা সময়কে বলেন, ‘ব্রিটিশ আমলে নীল চাষের ওই নিদর্শনটি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় সংরক্ষণ করবে কথা শুনেছি। তবে দীর্ঘদিন হলেও কাজের কোনও অগ্রগতি নেই। যেভাবে ১০ বছর আগেও দেখেছি, এখনও তাই দেখছি। ইংরেজদের শাসন ও শোষণের ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে এটি সংরক্ষণের দাবি জানাই।


এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক খন্দকার ইয়াসির আরেফীন বলেন, ভবনটি দেখতে গিয়েছিলাম। এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। আশা করি, অচিরে ওই পুরাকীর্তিটি সংরক্ষণের কাজ শুরু করা হবে।

সংবাদটি শেয়ার করুন

সর্বশেষঃ