সোমবার, ৬ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

সুস্বাদু খাবার ‘বাঁশ কোড়ল’, ঐতিহ্য হারাচ্ছে বাঁশশিল্প

আনোয়ার হোসেন , খাগড়াছড়ি

পার্বত্য অঞ্চলের অন্যতম জনপ্রিয় সুস্বাদু খাবার ‘বাঁশ কোড়ল’। মারমারা একে বলে ‘মহ্ই’ আর ত্রিপুরাদের কাছে ‘মেওয়া’। চাকমা ভাষায় বলা হয় ‘বাচ্ছুরি’। মূলত বাঁশের গোঁড়ার কচি নরম অংশকে বলা হয় বাঁশ কোড়ল।

পার্বত্য অঞ্চলের প্রায় সব স্থানেই মেলে এ সবজি। দেশের বিভিন্ন স্থানেও এটি এখন জনপ্রিয় একটি খাবারের নাম। বছরের মে থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত এ সবজির ভরা মৌসুম থাকে। মুলি বাঁশ, ডলু বাঁশ, মিতিঙ্গ্যা বাঁশ, ফারুয়া বাঁশ, বাজ্জে বাঁশ, কালিছুরি বাঁশসহ বেশ কয়েক প্রজাতির বাঁশ কোড়ল পাওয়া যায়। বিভিন্ন জাতের বাঁশ কোড়ল স্বাদে ভিন্ন। তবে মুলি বাঁশ কোড়ল সবচেয়ে সুস্বাদু হওয়ায় সবার কাছে এটি জনপ্রিয়। ফলে বাজারে এর চাহিদা ও দাম কিছুটা বেশি।

বর্ষার শুরুতে প্রায় প্রতিদিন বিকেলে জেলা শহরের মার্মা বাজারে আদিবাসী ব্যবসায়ীরা বাঁশ কোড়ল নিয়ে আসেন। এখানে কোড়ল কিনতে আসেন সব জাতি-গোষ্ঠীর ক্রেতারা। প্রতি কেজি বাঁশ কোড়ল বিক্রি হয় ৫০ টাকা। পার্বত্য অঞ্চলে ঘুরতে আসা পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ এটি।

জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও প্রাকৃতিক কারণেও বাঁশবন উজাড় হয়ে যাচ্ছে। ফলে চাহিদার তুলনায় বাঁশ কোড়ল এখন অপ্রতুল। সরকারিভাবে বাঁশবন সংরক্ষণ করা না গেলে একসময় পার্বত্য অঞ্চল থেকে হারিয়ে যাবে বিভিন্ন প্রজাতির বাঁশ। সেইসঙ্গে বাঁশ কোড়ল।

বছরের জুন-আগস্ট মাসে বর্ষা মৌসুমে বাঁশের বংশ বৃদ্ধি হয়। এ সময় পাহাড়ের গায়ে মাটি ভেদ করে উঠতে শুরু করলে পাহাড়িরা তা সংগ্রহ করে বাজারজাত করেন। স্যুপ, মুন্ডি, মাংস দিয়ে রান্না ও ভাজি করে খাওয়া যায় বাঁশ কোড়ল। দিন-দিন এর চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় বান্দরবানসহ তিন পার্বত্য জেলায় বাঁশের উৎপাদন কমে যাচ্ছে বলে গবেষণায় উঠে এসেছে। ফলে সম্প্রতি পার্বত্য অঞ্চলে পর্যাপ্ত বাঁশ উৎপাদন বৃদ্ধি এবং বাঁশবন রক্ষণাবেক্ষণের স্বার্থে জুন-আগস্ট পর্যন্ত বাঁশ কোড়ল আহরণ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বন বিভাগ।

বাঁশ দিয়ে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস তৈরি করা হয়। যেমন, ঝুড়ি, ঝাকা, চালুন, খাঁচা, পাটি, খাড়ি, ঝাড়ু, কুলা, হাতপাখা, মাদুর, ইত্যাদি। বাঁশের দোলনা, বাড়ি-ঘরের বেড়া, ঘরের খুঁটি, ঘরের মাচা, ঘরের খাট বাঁশ দিয়ে তৈরি করা যায়। ঘরের আসবাব হিসেবে মোড়া, চাটাই, সোফা, বুকসেলপ, ছাইদানি, ফুলদানি, প্রসাধনী বাক্স, ছবির ফ্রেম, আয়নার ফ্রেম, সিগারেট রাখার ছাইদানি, নুনদানি, পানদানি, চুনদানি, ইত্যাদি বহুল প্রচলিত।

বিশাল জনগোষ্ঠীর একটি অংশ বাঁশ ব্যবসা ও বাঁশশিল্পের সাথে জড়িত। বাঁশশিল্পকে পুঁজি করে দেশের বিভিন্ন স্হানে গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা। কিন্তু বাঁশের অঙ্কুরকালে এটাকে অনেকেই তরকারি হিসেবে ব্যবহার করায় এ ঐতিহ্যের বাঁশশিল্প দিনদিন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।

এ বাঁশ শিল্প ও ঐতিহ্য রক্ষার লক্ষে বাঁশ কোড়ল অর্থাৎ বাঁশের অঙ্কুর নষ্ট না করার জন্য বলা থাকলেও স্থানীয় এবং সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের তদারকি না থাকায় বর্তমানে প্রশাসনের নাকের ডগায় উপজেলা সদরেও বিক্রি হচ্ছে দেদারছে। এতে দিন দিন উপজেলার বিভিন্ন পাহাড় থেকে বিলুপ্ত হতে চলেছে বাঁশের বংশ।

সংবাদটি শেয়ার করুন

সর্বশেষঃ